Thursday, November 20, 2025
spot_img
হোমঅন্যান্যসৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক: জিয়াউর রহমানের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প

সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক: জিয়াউর রহমানের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প

‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একজন নেতা আছেন, যিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, বরং একজন সৈনিক হিসেবে জাতির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তিনি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১১ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে নিজেই বলেছিলেন—

“আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।”

তবু ইতিহাসের গতিপথে এই সৈনিকই হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রের কর্ণধার, বাংলাদেশের পুনর্গঠনের নায়ক।


যুদ্ধক্ষেত্র থেকে জাতীয় নেতৃত্বে উত্থান

জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তার সূত্রপাত রাজনীতিতে নয়, যুদ্ধে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার হিসেবে অসাধারণ নেতৃত্বে লাহোর রক্ষা পান। সেই বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ পদকে ভূষিত করে।

ছয় বছর পর, ১৯৭১ সালে, তিনি আবারও ইতিহাসে নিজের নাম লেখান। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হিসেবে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং গঠন করেন বিশেষ ‘জেড ফোর্স’। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে তার মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।


অভ্যুত্থানের ঘূর্ণাবর্তে উত্থান

স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে নানা অসন্তোষ, অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় দেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে খন্দকার মোশতাক। এরপর সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসে জিয়া।

৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে গৃহবন্দি হন জিয়া, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত সেনাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ‘চিফ অব স্টাফ বন্দি’—এই খবর সৈনিকদের ক্ষোভে ফুঁসে তোলে। লেখক এম. এ. হামিদ তার বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’-তে লিখেছেন,

“খালেদ ও শাফায়েত বুঝতেই পারলেন না, তাদের এ পদক্ষেপ জিয়ার ইমেজ আকাশচুম্বী করে তুলেছে।”


৭ নভেম্বর: সৈনিক–জনতার বিপ্লব

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো দিন। “সিপাহী-জনতার বিপ্লব” নামে পরিচিত এই আন্দোলনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন। তার বাসভবনের সামনে সৈনিকদের স্লোগান ছিল—

“সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ!”

এই বিপ্লবে সেনা ও বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন জাসদের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কর্নেল আবু তাহের জিয়াকে মুক্ত করতে ভূমিকা রাখেন। তবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে জিয়াই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন সেনাবাহিনীতে এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন।


রাষ্ট্রনায়ক জিয়া: নতুন দিগন্তের সূচনা

৭ নভেম্বরের পর জিয়া উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন, যা বাকশালের একদলীয় শাসনের বিপরীতে একটি নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত খুলে দেয়।

তার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’—যেখানে কেবল বাঙালি নয়, দেশের সব জাতিগোষ্ঠীকে এক পরিচয়ে একত্রিত করার আহ্বান ছিল। নিজের বই ‘আমার রাজনীতির রূপরেখা’-এ তিনি লিখেছিলেন,

“যে রাজনীতির অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের মাটি থেকে জন্মাবে না, সে রাজনীতি বাংলাদেশের মাটিতে টিকে থাকবে না।”


অর্থনীতি ও উন্নয়নে দূরদর্শী পদক্ষেপ

জিয়ার শাসনামলে দেশ পায় অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের নতুন দিশা। তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা করেন, পোশাক শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেন এবং বিদেশে রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করেন—যার সুফল আজও ভোগ করছে বাংলাদেশ।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাস ‘দেয়াল’-এ লিখেছেন,

“জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোক দেখানো সৎ নয়, আসলেই সৎ। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল জিয়া পরিবারের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই।”


বিয়োগান্ত পরিণতি

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। তার মৃত্যু আজও রহস্যে ঢাকা।


উপসংহার

একজন সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক—জিয়াউর রহমানের জীবন কাহিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে যেমন বিতর্কিত, তেমনি প্রভাবশালী। যুদ্ধক্ষেত্রের বীর থেকে রাজনীতির মঞ্চে উঠে আসা এই নেতা নিজের কর্মে, নীতিতে এবং দেশপ্রেমে গড়ে তুলেছিলেন এক কিংবদন্তি।

সংগৃহীত

টাঙ্গাইল উত্তর সর্বশেষ

জনপ্রিয়