পথ চলতে গিয়ে মেঠো পথের পাশে কিংবা জঙ্গলে বুনো একটি ফুলের দেখা মেলে প্রায় সব স্থানে। সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে বুনো ফুলটি দৃষ্টি কেড়ে নেয়। অপলক দৃষ্টিতে এ ফুলটির দিকে চেয়ে থাকার মধ্যে এক ভীষণ রকমের আনন্দ কাজ করে। নিজেকে তখন প্রেমিক বা কবি ভাবার আনন্দে অনেকটা আবেগ নিয়েই ফুলটি ছিঁড়ে নিয়ে যান অনেকে। বলছিলাম পথে-প্রান্তরে শে^ত-শুভ্রতায় ছড়ানো ভাঁট ফুলের কথা।
এটি গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত একটি বুনো ফুল। এ ফুলে বিমোহিত হয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতার সেই ভাঁটফুল এখন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে টাঙ্গাইল সদরের আঁকা বাঁকা গ্রামীণ পথের ধারে। কবি জীবনান্দ ভাঁট ফুল নিয়ে যে আবেগে লিখেছেন, ভাঁট আশ শ্যাওড়া বন বাতাসে কী কথা কয় বুঝি নাকো, বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে, পৃথিবীর কোনে পথে দেখি নাই হায়, এমন বিজন পথের ধারে দু’প্রান্তে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম গ্রহন করে থাকে’। ভাঁট বা ভাইট ফুল নিয়ে কবির এমন বর্ণনার বাস্তবতার দেখা মেলে অলোয়া বরটিয়া ছাড়া বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলের সর্বত্র। অল্প বিস্তর দেখা মেলে শহরের বিভিন্ন মাঠ কিংবা পড়ে থাকা জঙ্গলে।
ভাঁট ফুলে রয়েছে মিষ্টি সৌরভ। ফুল ফোটার পর মৌমাছিরা ভাঁট ফুলের মধু সংগ্রহ করে। গ্রামের মেঠো পথের ধারে, পতিত জমির কাছে কাছে এরা জন্মে থাকে এবং কোনরুপ যত্ন ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠে।
বসন্তের আগমনে পলাশ-শিমুলের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতিকে সাজাতে সাদা ভাঁট ফুলের শুভ্রতার জুড়ি নেই। শুভ্র সাদা ভাঁট ফুল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় যেকোনো ফুলপ্রেমীর। বিশেষ করে পরিত্যক্ত মাঠ, বন, রাস্তা কিংবা জলাশয়ের পাশে মিষ্টি ঘ্রানের, অজস্র ভাঁট ফুল ফোটা অবস্থায় চোখে পড়ে। প্রতিটি গাছে এক সঙ্গে অনেক ফুল ফুটে। অঞ্চলভেদে এই গাছের ফুলকে ভাইটা ফুল, ভাটির ফুল, ঘেটু ফুল, ভাত ফুল, বনজুঁই, ঘণ্টাকর্ণ বলা হলেও অলোয়ার বরটিয়া কিংবা করটিয়ার গড়াশিন মানুষের কাছে এটি ভাঁট ফুল বা ভাটির ফুল নামেই সর্বাধিক পরিচিত। চৈত্র মাসে এই ফুল ফোটে বলে কেউ কেউ একে চৈত্রের ফুলও বলেন।
করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম তপনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ভাঁট ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ক্লেরোডেনড্রাম ভিসকোসাম’ ও ইংরেজি নাম ‘হিল গেন্টারি বোয়ার ফ্লাওয়ার’। এটি গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এই গাছের প্রধান কান্ড খাড়া, সাধারণত ২-৪ মিটার লম্বা হয়। পাতা কিছুটা পানপাতার আকৃতির ও খসখসে। পাতা ৪-৭ ইঞ্চি লম্বা হয়। ডালের শীর্ষে পুষ্পদন্ডে ফুল ফোটে। পাপড়ি সাদা, তাতে বেগুনি মিশেল থাকে। বনজুঁই সৌন্দর্যবর্ধন ছাড়াও নানা গুণে গুণান্বিত। ম্যালেরিয়া, চর্মরোগ ও পোকা-মাকড়ের কামড়ে খুবই উপকারী।
বাংলা বিভাগের অধ্যাপক,কবি ও ধারাভাষ্যকার অনীক রহমান বুলবুল বলেন, পথের ধারের এক নান্দনিক সৌন্দর্য ভাঁটফল। নাম না জানা কত ফুল ফোটে আমাদের চারপাশে। সৌন্দর্যে বিমোহিত হই, ভালোলাগায় মন ভরে যায়। তবু অনাদরে অবহেলায় নাম জানিনা কত ফুলের। কবি জীবনানন্দের কবিতায় বাংলার রুপ মাধুরীর বর্ণনা পাই ভাঁটফুলের। ইন্দ্রের রাজসভায় নেচেছিল বেহুলা। বেগুলার পায়ে ঘুঙুরের মতো নেচেছিল অবহেলিত এই ভাঁটফুল।
প্রকৃতিপ্রেমী মাহবুব আলম উজ্জল বলেন, ‘সড়কের পাশে যখন ফুলগুলো দেখি, তখন মনে হয়, কেউ যেন আস্ত একটি ফুলের তোড়া তৈরি করে রেখেছে। অবাক করা বিষয় হলো, ফুলটি চাষ না করেই আমরা এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি।’
হর্টিকালচার সেন্টার, জামালপুর জেলার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আরিফুর রহমান জানান, ভাঁটফুল একটি গুল্মজাতীয় দেশি বুনো পুষ্পক উদ্ভিদ। এটি বুনো ফুল। গাঁয়ের মাঠে কিংবা রাস্তার ধারে অযত্নে ফোটে এই ফুল। ভাট ফুলে আছে অনেক উপকারিতা। বিষাক্ত কিছু কামড় দিলে ফুলের রস ক্ষত স্থানে দিলে দ্রুত সেরে যায়। অনেকে কৃমি দূর করার জন্য এ ফুলের রস খেয়ে থাকেন। গরু ছাগলের গায়ে উকুন হলে ভাট গাছের পাতা বেটে দিলে উকুন মরে যায়। কিন্তু আগের লোকজন ভাট ফুলের ভেষজ ঔষধিগুণ জেনে এসব চিকিৎসা করত। বর্তমান প্রজন্ম এ গাছের গুনাগুণ সম্পর্কে জানে না। তাই এ উদ্ভিদ সংরক্ষণ করা জরুরি।