‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান’ – দার্শনিক, লেখক ও সন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের সর্বাধিক উদ্ধৃত ওই উক্তিকে ধারণ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন এক যুবক ব্যবসায়ী। দিলিপ কুমার সাহা নামে ওই ব্যবসায়ীর বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া গ্রামে। তিনি বিদেশি প্রজাতির কুকুরের খামার গড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। শখের বশে কুকুর পালন থেকে এখন তিনি বিশাল খামারের মালিক।
‘অর্ক ক্যানেল’ নামে কুকুরের খামারটি এখন এলাকার গর্ব হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। প্রতিদিন অনেক লোক তার খামারটি ও খামারের কুকুর দেখতে ভির জমাচ্ছেন। তার খামারের কুকুর অনলাইন ও অফলাইনে বিক্রি করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তাকে অনুকরণ করে এলাকার যুবকরাও স্বপ্ন দেখছেন কুকুরের খামার করার।
‘অর্ক ক্যানেল’ নামের ওই খামারে ডগ আর্জিণ্টিনা, পিট বল, ইউএস বুলি, কান কোর্সো, ফ্রান্স মার্সিভ, চাউচাউ, রাশিয়ান শামওয়েট, হোয়াইট টেরিমার, বাছে হাউন, বিগ্রোল ও টিবিভিয়ান মার্সিভ সহ ২৪ জাতের ৭০টি কুকুর রয়েছে। এসব কুকুর তিনি ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করেছেন।
ওই খামারে দোকান ও অফিস পাহারা, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির হেফাজত, ঘরবাড়ি এবং অপরাধের উৎস সন্ধান ও অপরাধীকে চিহ্নিত করার মতো কুকুরও পাওয়া যায়। এমনকি ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করা জাতের কুকুরও রয়েছে ওই খামারে। কুকুরগুলোকে সকাল-বিকাল ভাত, মাংস, সবজি একত্রে রান্না করে খাওয়ানো হয়।
ওই খামারে স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার অনেকেই তার খামার দেখে কুকুর পালনে এগিয়ে এসেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা খামার পরিদর্শনে আসছেন।
দিলিপ কুমার সাহা জানান, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের ভিতরেই আছে। এ কথা বিশ্বাস করো, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।’
স্বামী বিবেকানন্দ আরও বলেছেন- ‘পৃথিবীর ইতিহাস কয়েকজন আত্মবিশ্বাসী মানুষেরই ইতিহাস। সেই বিশ্বাসই ভিতরের দেবত্ব জাগ্রত করে। তুমি সব কিছু করিতে পার।’ স্বামী বিবেকানন্দের ওই বাণী তাকে কুকুর পালনে উদ্বুদ্ধ করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে কুকুর পালন করা দেখেছেন। তখনই কুকুরের খামার করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিলিপ কুমার সাহা জানান, ২০১৪ সালের দিকে প্রথমে এক প্রকার শখের বশে নিজের বাড়িতে পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশি প্রজাতির কুকুর পোষা শুরু করেন। ধীরে ধীরে কুকুরের সংখ্যা বাড়লে নানা কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে অনেকে তার কুকুর কিনতে আসেন এবং বিক্রিও করেন। পরে তিনি আরও কয়েক জাতের কুকুর সংগ্রহ করেন। আড়াই বছর আগে বাড়ির আঙিনায় ২০ শতক জমিতে গড়ে তোলেন কুকুরের খামার ‘অর্ক ক্যানেল’।
‘অর্ক ক্যানেল’ নামের খামারে কাজ করা শ্রমিক মাসুদ মিয়া জানান, তিনি আগে কৃষি কাজ করতেন, তখন জমিতে নিয়মিত কাজ হত না। দুই বছর ধরে এই খামারে চাকুরি করছেন। নিয়মিত কাজ থাকায় এখন আর কাজ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না- বেতনও নিয়মিতই পান।
ওই শ্রমিক আরও জানান, তারা ৩-৪ জন লোক ওই খামারে কাজ করছেন। জমিতে চাষাবাদ করতে ঝড়-বৃষ্টি ও রোদের মধ্যে মাঠে কাজ করতে হত। এখন আর তা করতে হয় না। সকাল ৭ টায় খামারে আসেন আবার সন্ধ্যা ৭ টায় বাড়ি চলে যান। যা বেতন পান তাতে মোটামুটি ভালোভাবেই সংসার চলে যায়।
মহেড়া গ্রামের মানিক মিয়া, আবুল হাসেম, জনি সহ অনেকেই জানান, তারা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে এবং ইণ্টারনেটের বদৌলতে বিভিন্ন দেশে অনেক হাঁস, মুরগী ও গরু-ছাগলের খামার দেখেছেন- কিন্তু কখনও কুকুরের খামার দেখেন নি। এই প্রথম তাদের গ্রামে কুকুরের খামার করে দিলিপ কুমার সাহা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
কুকুর লালন-পালন করেও যে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, সচ্ছল জীবন-যাপন করা যায়। তার জ্বলন্ত প্রমপাণ দিলিপ কুমার সাহা। এখন অনেক লোক দূর-দূরান্ত থেকে তার খামার দেখতে গ্রামে আসে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রতন মিয়া জানান, জমিদার বাড়ি ও পুলিশ ট্রেনিং সেণ্টারের পাশাপাশি কুকুরের খামারের কারণে মানুষ নতুনভাবে মহেড়া গ্রামকে চিনবে। কুকুরের খামার করে দিলিপ কুমার সাহা এলাকার মানুষকে অবাক করে দিয়েছেন। তার দেখাদেখি এলাকার যুবকরা কুকুরের খামার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে।
কুকুরের খামার অর্ক ক্যানেলের পরিচালক গৌতম সাহা জানান, তাদের খামারে ফ্যামিলি ডগ, টয়বিড, গার্ডিন সহ বিভিন্ন প্রজাতির কুকুর রয়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা কুকুর কিনতে আসে। আবার অনলাইনেও কুকুর বিক্রি করা হয়। তারা অনলাইনে খামারের একটি পেইজ খুলেছেন।
সেখানে ক্রেরাতা তাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্ডার দেন। তাদের চাহিদা অনুযায়ী কুকুর সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, অর্ক ক্যানেল থেকে কুকুর কিনলে তিনি আমদানি করা কুকুরের চেয়ে ৫০ শতাংশ সাশ্রয়মূল্যে সরবরাহ করে থাকেন।
অর্ক ক্যানেলের মালিক দিলিপ কুমার সাহা জানান, উন্নত বিশ্বের জনপ্রিয় পোষা প্রাণি কুকুর। অর্ক ক্যানেলের কুকুর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে। অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই জনপ্রিয় পোষা প্রাণিগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে।
তিনি জানান, প্রতিটি কুকুর প্রজাতি ও আকার ভেদে ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। তার কাছ থেকে কুকুর ক্রয় করলে অন্য দেশ থেকে আমদানি করা কুকুরের চেয়ে শতকরা ৪৫-৫০ ভাগ সাশ্রয়ী হবে।
তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত খামারের অবকাঠামোসহ সব মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সরকার বা ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পেলে খামারটি পরিচালনা করতে অনেক সহজ হবে।
(বুলবুল মল্লিক, ঘাটাইল ডট কম)/-
কপিরাইট © ২০১৮ - ২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত |
Design & Developed by RAN SOLUTIONS
আপনার মতামত লিখুন