বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই অগাস্টের ভোরে সপরিবারে হত্যার পর ওই দিনই রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ৮৩ দিন। তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ মুজিব সরকারের অনেক কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ''আসলে তাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল, খুনীচক্র তাকে বসিয়েছিল। আমার মনে হয়, তিনি অনেকটা শিখণ্ডির মতোই ছিলেন। তারপরেও যেহেতু তার নেতৃত্বে সরকারটি হয়েছিল এবং সরকারের সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের, তারা ১৫ই অগাস্টের আগের ও পরের অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিলেন।''
মি. আহমেদ উদাহরণ হিসাবে বলেন, ''১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত বাকশাল ব্যবস্থা ছিল। একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে বাকশালের একদলীয় ব্যবস্থা রদ করেন। দ্বিতীয়ত, অনেকগুলো পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো খোলা শুরু করেন। তৃতীয়ত, ব্যক্তি পুঁজির একটি সিলিং (উর্দ্ধসীমা) ছিল তিন কোটি টাকা পর্যন্ত, সেটা তিনি ১০ কোটি টাকা করেন এবং প্রাইভেটাজাইশনে একটা গতি আনার চেষ্টা করেন।''
''তিনি একটা সাম্প্রদায়িক আবহ, যেটা একাত্তরের পর থেকে মোটামুটি ধামাচাপা পড়ে ছিল আমি বলবো, তিনি সেটা আরও উস্কে দেন। সবচাইচে বড় কথা হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে তার প্রশ্রয়ে একটা নেতিবাচক প্রচারণা চলতে থাকে।''
এই গবেষক বলছেন, ''ওই তিরাশি দিন যদি আরও দীর্ঘায়িত হতো, তাহলে তিনি হয়তো আরও অনেক কিছু করতেন। তবে তিনি যেই সরকারের অংশ ছিলেন ১৫ই অগাস্টের আগ পর্যন্ত, ঠিক তার অনেকটাই বিপরীতধর্মী কাজ তিনি ওই সময়ে করেছেন।''
ক্ষমতা নিয়েই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা
১৫ই অগাস্ট যখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের রক্তের দাগও শুকোয়নি, তখন নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের তিনি 'জাতির সূর্য সন্তান' বলে আখ্যা দেন।
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর 'এক জেনারেলে নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতা প্রথম দশক' বইতে লিখেছেন, ''শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি 'জয় বাংলা' ধ্বনির স্থলে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশ বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।''
নতুন সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান।
১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করলেন এবং নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ফলে তার সেই সরকারে ১২ জন মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী থাকলেও কোন প্রধানমন্ত্রী পদ ছিল না। এই মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া বেশিরভাগই ছিলেন আগের মন্ত্রিসভার সদস্য।
নিজে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণের পরেই উপরাষ্ট্রপতি করেন শেখ মুজিব সরকারের ভূমিমন্ত্রী মোহাম্মদ উল্লাহকে।
গ্রেপ্তার অভিযান
আনোয়ার উল আলম তার 'রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা' বইয়ে লিখেছেন, ''খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণ এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ২৩শে অগাস্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা তাকে সমর্থন করতে এবং তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করেন, তাঁদের বন্দী করেন।''
মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী 'এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক' বইতে লিখেছেন, ''ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে (এমএজি ওসমানী) একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য।''
''মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিল। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উৎসাহিত করতেন।'' লিখেছেন মইনুল হোসেন চৌধুরী।
ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তা এবং নতুন সরকারের সদস্যদের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ ছিল রক্ষীবাহিনী। তাই অগাস্টেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে সামরিক বাহিনীর সাথে একীভূত করে ফেলা হবে।
সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানী রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।
জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের জয় বাংলা অনেকটা জাতীয় শ্লোগান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। স্বাধীনতার পরে এই শ্লোগানই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়েই তার প্রথম বক্তব্যে 'জয় বাংলা'র বদলে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলতে শুরু করেন।
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে 'রেডিও বাংলাদেশ' নাম নির্ধারণ করেন।
জাতীয় পোশাক
সেই সময়ের পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, ছয়ই অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, রাষ্ট্রীয় পোশাক হবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সবসময়ে যা পরে থাকতেন, সেই আচকান ও শেরওয়ানি।
কোন কোন গবেষক লিখেছেন, মোশতাক যে টুপিটি মাথায় পরতেন, সেই টুপিটিকে জাতীয় টুপি ঘোষনা করা হয়। বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে এই টুপি ও পোশাক পরে যোগদান করতে হবে।
চৌঠা অক্টোবর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গেও কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করা হয়।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ বা বিচার যাতে না করা যায়, সেই দায়মুক্তি দিয়ে ২৬শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বাংলাদেশের সংসদে সেই অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়। ফলে সেটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসাবে অনুমোদিত হয়।
১৯৭৯ সালের সাতই জুলাই বাংলাদেশের সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী করে সেটি সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে হত্যাকাণ্ডের ২১ বছরের মধ্যে হত্যাকারীদের কারও কোন বিচার হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ১২ই নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে পার্লামেন্ট। ২০১০ সালে পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের হাইকোর্ট।
জেল হত্যা
তেসরা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। সেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নির্দেশে।
২০১০ সালে সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান বলেছেন, "টেলিফোনে বলা হলো প্রেসিডেন্ট কথা বলবে আইজি সাহেবের সাথে। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে আইজি সাহেবকে খবর দিলাম। কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলছে আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।"
চার নেতাকে একটি কক্ষে একত্রিত করার পর গুলি করে হত্যা করে সেই সেনা সদস্যরা।
তেসরা নভেম্বরেই খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ছয়ই নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশ্য জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেয়ার পর পরের বছর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
কে এই খন্দকার মোশতাক
বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে যে নামটি সবার আগে আসে, তা হলো খন্দকার মোশতাক আহমদ। দেশের আপামর জনগণের কাছে একজন নিন্দিত ও ঘৃণিত ব্যক্তি। বন্ধু হিসেবে বুকে টেনে নেওয়া জাতির পিতার হত্যার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন এই বিশ্বাসঘাতক।
১৯১৯ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির দশপাড়া গ্রামে জন্ম মোশতাক আহমদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারী এই ঘাতকের শুরুর জীবন এতটা কালিমালিপ্ত দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ ছিলেন তিনি।
ছাত্র রাজনীতিতে তার বিচরণ ছিল। মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতৃত্ব পালন করেন। পরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। এ সময় উদীয়মান তরুণ এবং ক্যারিশমেটিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে আসেন মোশতাক। তখন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিল তার পদচারণা।
মোশতাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অতি ভক্ত। আওয়ামী লীগের ভেতর তিনি ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দলে বামপন্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে মোশতাক আওয়ামী লীগে আরও ‘গুরুত্বপূর্ণ‘ হয়ে ওঠেন। অতি বিনয়ী ভদ্রতার মুখোশ পরা হাসিতে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন।
খন্দকার মোশতাক ১৯৪২ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে ১৯৫৪ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্ত হয়ে আবারও সংসদে যুক্তফ্রন্টের চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করার পর তিনি আবারও বন্দি হন। তিনবার জেল খেটে বঙ্গবন্ধুর আরও কাছে আসেন। ৬ দফা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গ্রেফতারও হন।
দেশের আটটি রাজনৈতিক দল ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করলে তাতে খন্দকার মোশতাক আহমদ পশ্চিম পাকিস্তান অংশের সমন্বয়ক ছিলেন। ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনেও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোশতাক অন্যদের মতো ভারতে পাড়ি জমান এবং মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলে সেখানেও বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয় মোশতাককে।
১৯৭৫ সালে মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করে তাকে করা হয় বাণিজ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভারত নীতিতে মোশতাকের সমর্থন ছিল না। তবুও বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবজাত মহানুভবতায় তাকে নবগঠিত বাকশালে ঠাঁই দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য ও আসামির জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, পচাঁত্তরের মাঝামাঝি মোশতাকের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তিনি নিজে ও আত্মীয়দের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের নিয়ে জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ সময় গাজীপুর, কুমিল্লাসহ ঢাকায় সহযোগীদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর জবাববন্দিতে বলেন, ‘‘১৯৭৫ সালের মে বা জুনের প্রথম দিকে গাজীপুরের সালনা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সালনাতে মোশতাক সাহেব সেনা অফিসারদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের আন্দোলনের অবস্থা কী?’ জবাবে তারা জানান যে, ‘বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমরা তার প্রতিনিধি।’ ১৯৭৫ সালের জুনে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সেনা অফিসারদের মধ্যে মেজর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুক যোগদান করেন।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর হত্যার মূল পরিকল্পনায় যে মোশতাক ছিলেন, তা স্পষ্ট হয় ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরপরই। ওইদিনই মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সূর্যসন্তান বলে আখ্যায়িত করেন।
তার শাসনামলেই চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। কারাবন্দি করা হয় আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মীকে। অবশ্য এত কিছুর পরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি মোশতাক। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর খালেদ মোশারফের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।
৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে তাকে বন্দি করা হয়। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর মোশতাক প্রথমে বন্দি থাকলেও ১৯৭৬ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে ডেমোক্রেটিক লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়।
তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। আদালত তাকে পাঁচ বছরের শাস্তি প্রদান করেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন।
তবে রাজনীতিতে আর সফলতা পাননি। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী আ.ফ.ম. মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এর আগেই ওই বছরের ৫ মার্চ মোশতাক মৃত্যুবরণ করেন। ফলে হত্যার দায় থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
মৃত্যুর পর পুলিশ পাহারায় দাউদকান্দির দশপাড়ায় তাকে দাফন করা হয়। বর্তমানে সীমানা প্রাচীর ঘেরা তার বাড়িতে দোতলা একটি ভবন রয়েছে। এছাড়া, সেখানে একটি মসজিদ ও পারিবারিক কবরস্থান আছে। মোশতাকের ছেলেমেয়েরা বিদেশে বসবাস করেন। প্রথমদিকে তারা মাঝে মধ্যে দেশে এলেও জনরোষের ভয়ে গত কয়েক বছর ধরে তারা দেশে ফেরেননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে মোশতাক আহমেদের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন,‘‘খন্দকার মোশতাককে তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সূক্ষ্ম কূটচাল চালতে দেখেছেন। দেশে যখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছিল, মোশতাক বলাবলি করতেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে জীবিত পেতে চাইলে দেশ স্বাধীন হবে না।’
তবে আমরা কৌশল করে তার জবাবে বলতাম— দুটোই চাই। ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় মোশতাককে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। তখন অলিখিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় কাজ করতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। ওই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা জোরদার করেন মোশতাক। তার এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি প্রমাণিত হয় ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে।’’
‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে মোশতাককে নিয়ে বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বেশ কয়েকবার খন্দকার মোশতাক আহমদের নাম এসেছে। বইয়ের নির্ঘণ্টে দেখা গেছে, ৮টি পৃষ্ঠায় তার নাম বা প্রসঙ্গ এসেছে। দেখা গেছে, কোনও কোনও পৃষ্ঠায় একাধিকবার তার নাম এসেছে।
বইয়ে উল্লিখিত সময়ে খন্দকার মোশতাক নিজেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলে ছিলেন। কখনও একই জেলখানায় কখনও ভিন্ন স্থানে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বর্ণনায় কখনও কখনও মোশতাকের শারীরিক অসুস্থতা বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন।
রোজনামচা বইয়ে বঙ্গবন্ধু ও খন্দকার মোশতাক জেলে থাকতে কোনও এক বাংলা নববর্ষে (১৫ এপ্রিল) পরস্পরকে ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া, এক কোরবানির ঈদে একসঙ্গে নামাজ পড়ার কথাও রয়েছে। মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন। কখনও বা নাম উল্লেখ করেছেন। মোশতাক অন্য জেলে থাকলে বিভিন্ন মাধ্যমে তার খবর নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
জেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোশতাক সম্পর্কে বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার জায়গা থেকে আমি দেখলাম, মোশতাক হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসে রয়েছে। চেনাই কষ্টকর। বেচারাকে কী কষ্টই না দিয়েছে! একবার পাবনা, একবার রাজশাহী একবার ঢাকা জেল।’
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘খন্দকার মোশতাক আহমদ ও আবদুল মোমিন সাহেব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোশতাক সাহেবের শরীর খুবই খারাপ। ওজন অনেক কম হয়ে গেছে। মোমিন সাহেব এখন ভালো। তাদের সাথে দেখা হয়েছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা সব দলের ঐক্য চায়। তবে পূর্ব বাংলার দাবি ছেড়ে নয়, ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে।’
৬ দফা আন্দোলনের সময় একসঙ্গে জেলে যাওয়ার পর অন্যান্য নেতার পাশাপাশি মোশতাক সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন জাতির পিতা। তিনি লিখেছেন, ‘মোশতাক সাহেব তো পুরনো পাপী। অত্যন্ত সহ্য শক্তি, আদর্শে অটল। এবার জেল তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে— একবার পাবনা জেলে, একবার রাজশাহী জেলে, আবার ঢাকা জেলে নিয়ে। কিন্তু সেই অতি পরিচিত হাসিখুশি মুখ।’
২৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ সময়ের একটি বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন, বিশিষ্ট নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জেলে আছি। আমরা ছয় দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি।’
কারাগারের রোজনামচা বইয়ে জাতির পিতা যেসব রাজনীতিক বা ব্যক্তির বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছেন, বইটির শেষাংশে তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে খোন্দকার মোশতাক আহমেদও রয়েছেন।
বইটিতে তার জীবনী সম্পর্কে যা তুলে ধরা হয়েছে তা হলো— ‘খোন্দকার মোশতাক আহমদ (১৯১৯-১৯৯৬): বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নানা সন্দেহজনক ও বিতর্কিত কাজে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারের (১৯৭১-৭৫) বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মর্মান্তিক ও ষড়যন্ত্রমূলক হত্যায় তার (মোশতাক) গোপন সমর্থন ও সহায়তা ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৯৭৫-এ দেশদ্রোহী স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসায়। ক্ষমতায় বসেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের কতক মৌলিক রাষ্ট্রীয় আদর্শের পাশ্চাৎমুখী পরিবর্তন ঘটান। তিনি বাংলাদেশের একজন নিন্দিত রাজনীতিবিদ।
তথ্য সূত্র: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একাধিক আসামি ও সাক্ষীর সাক্ষ্য, কারাগারের রোজনামচাসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক বই এবং গণমাধ্যমে দেওয়া আমির হোসেন আমুর একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ।
কপিরাইট © ২০১৮ - ২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত |
Design & Developed by RAN SOLUTIONS
আপনার মতামত লিখুন