এলো হিজরি সনের নতুন বছর। স্বাগতম ১৪৪৪ হিজরি। হিজরি সনের সূচনা ও বিদায় ঘটে নীরবে নিঃশব্দে।
যতদূর জানা যায়, আরব দেশগুলোতে ঘটা করে উদযাপন করা হয় হিজরি নববর্ষ। এর বাইরে ব্রুনাইতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সনের বর্ষবরণ ঘটা করে পালন করা হয়। তবে আমাদের এ অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না।
মুসলিম হিসেবে হিজরি নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। ধর্মীয় কিছু দিবস ছাড়া আমরা হিজরি সন সম্পর্কে খুব একটা জানি না। আমরা অনেকেই জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়ত বা হিজরিবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাসও জানি না। হিজরি সনের তারিখের খবরও রাখেন না কেউ, এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না, তা খুবই দুঃখজনক।
হিজরি সনের মাসের প্রথম দিনে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় কোনো নিউজ আসে না, এমনকি কোন টিভি চ্যানেল এ সম্পর্কে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান রাখে না। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের মুসলমানগণ ইসলামী সংস্কৃতি স¤পর্কে কতটা উদাসীন। যেমন পালিত হতে দেখি ঈসায়ি ও বাংলা নববর্ষ।
মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যে কোনো সন তারিখ নির্ধারণ করতে পারে। তবে হিজরি সন তারিখের আছে বিশেষ গুরুত্ব। রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর বিভিন্ন প্রয়োজনে বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবাদের পরামর্শে হিজরি সনের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু আরবি মাসসমূহের প্রবর্তন পৃথিবীর সূচনা থেকে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহর নিকট গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই-এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা তাওবাহ : আয়াত ৩৬) অনুরূপ বক্তব্য রাসূল (সা.) থেকেও প্রমাণিত, যা সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে।
এ চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম (সা.) বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসীর ইবনে কাসির)।
এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে লিখেছেন, উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাসের যে ধারাবাহিকতা ইসলামি শরিয়তে প্রচলিত রয়েছে, তা মানব রচিত নয়; বরং মহান রাব্বুল আলামীন যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনই মাসের তারতিব ও বিশেষ মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হুকুম-আহকাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
এ আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চান্দ্র মাসই নির্ভরযোগ্য। চান্দ্র মাসের হিসাব মতেই রোজা, হজ ও জাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে আল্লাহপাক কুরআন মজিদে চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল তারিখ ঠিক করার মানদন্ডরূপে অভিহিত করেছেন।
সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়। তাই শরিয়তের বিধি-বিধানকে চন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্য চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব।
চাঁদের হিসাব ঠিক রেখে অন্যান্য সূত্রে হিসাব ব্যবহার করা জায়েজ আছে। তবে ইসলামি বিধি-বিধান সবগুলোই আরবি মাসের হিসাবে। যেমন: রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ, তালাকের ইদ্দত পালন, বিধবা স্ত্রীর ইদ্দত পালন, সন্তানের দুগ্ধপানের বছর পূর্তি ইত্যাদি। এজন্য প্রতিটি মুসলিমকে হিজরি মাস সম্পর্কে সাধারণ ধারণা রাখা উচিত।
ইসলামি শাসন ব্যবস্থার সময় সবকিছুর হিসাব হিজরি সন ধরে হতো। পরবর্তীতে সময়ের পরিবর্তনে এর ব্যবহার হ্রাস পায়। কিন্তু ইসলামি বিধি-বিধান আরবি মাসের হিসাবে আরোপিত। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এর ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। হাদিস শরীফে নতুন চাঁদ দেখার দোয়াও বর্ণিত হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ত্যাগ ও কুরবানির ঐতিহাসিক স্মৃতিস্মারক হিজরি সন। ইসলামের প্রচার, প্রসার এবং বিজয় কেতন উড্ডীনে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যাধিক। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের জ্ঞানপাপীরা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামকে পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী দ্বীন প্রচারে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে মাদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন। যাকে কেন্দ্র করেই আজকের হিজরি সন। যা আজো মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে আলোকবর্তিকা হিসেবে জাগরিত হয়ে আছে।
মনে রাখা জরুরি যে, হিজরি সনের প্রথম মাস মহরম। এ মাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। মুহররম মাস শুধুমাত্র কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাসই নয়, এ মাস গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার, ত্যাগের, ভালো কাজ করার, খারাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকার এবং মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ার প্রতিজ্ঞা করার মাস। ইসলাম ও মুসলমানের জন্য এ মাসের রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় ও পালনীয় বিষয়। তাইতো এ মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখা উত্তম।
হিজরি মাসের চাঁদ দেখাও ইবাদতের অংশ বলা যায়। হিজরি সনের সূচনা-ইতিহাস আলোচিত হলে স্মরণ হয় রাসুল (সা.) এর হিজরত প্রসঙ্গ। হিজরতের সে ঘটনা মুসলিম হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এসব বিবেচনায় আমাদের আরবি মাস তথা হিজরি নববর্ষ সম্পর্কে সম্মক ধারণা রাখা উচিত।
প্রচলিত ধারার বাংলা, ইংরাজি নববর্ষ উদযাপনের মতো হিজরি নববর্ষ পালন কাম্য নয়। তবে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চা, হিজরতের ইতিবৃত্ত এবং ইসলামী কাল-সময় চর্চার স্বরূপ হিসেবে কিছুটা হলেও হিজরি নববর্ষের প্রচার-প্রচলন, আলোচনা বিশেষভাবে প্রয়োজন মনে করি।
হিজরি নববর্ষ বিশ্ব মানবতাকে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ত্যাগের দিকেই আহবান করে। হিজরি নববর্ষ হয়ে উঠুক মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির বছর। আসুন, হিজরি নববর্ষে ইসলামের আলোয় আলোকিত হই। বিগত দিনের অন্যায় ও গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ করি। যে মহান উদ্দেশ্যকে স্মরণ করতে হিজরি সন শুরু হয়েছিল, আল্লাহ তাআলা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে হিজরি বর্ষের সে উদ্দেশ্যের স্মরণ, মর্যাদা ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখার, আমলি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন।
হিজরি নববর্ষে পবিত্র কাবাঘরে নতুন গিলাফ
মহররম মাস শুরুর মুহূর্তে পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়েছে। হিজরি নববর্ষকে স্মরণীয় করতে এবারই প্রথম ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। শনিবার (৩০ জুলাই) থেকে সৌদি আরবে হিজরি নববর্ষের মহররম মাস শুরু হয়। তাই শুক্রবার (২৯ জুলাই) দিবাগত রাতে কাবাঘরে মোড়ানো হয় নতুন গিলাফ।
বছরে একবার কাবাঘরে নতুন গিলাফ মোড়ানো একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। ৯ জিলহজ আরাফা প্রাঙ্গণে হাজিরা চলে গেলে যখন কাবা প্রাঙ্গণ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে, তখন কাবার গিলাফ পরিবর্তনের রীতি চলে আসছিল। কিন্তু এবার ১৪৪৪ হিজরি সনের প্রথম মুহূর্তে ঐতিহাসিক এই আয়োজনের কথা জানান পবিত্র দুই মসজিদের জেনারেল প্রেসিডেন্সি বিভাগের শায়খ ড. আবদুর রহমান আল সুদাইস। সৌদি বাদশাহর রাজকীয় নির্দেশনায় তা পরিবর্তন করা হয় বলে জানান তিনি।
প্রতিবছরের নতুন গিলাফ তৈরির জন্য রয়েছে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। মক্কার উম্মুল জাওদে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা’স কিসওয়াহ’। এখানে কর্মরত দুই শ কর্মকর্তা কাবার গিলাফ পরিবর্তনের কাজটি সম্পন্ন করেন।
১৩৪১ মোতাবেক ১৯৬২ সালে সৌদির প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন আবদুর রহমান আলে সৌদ গিলাফ তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নির্দেশ দেন। ১৩৯৭ মোতাবেক ১৯৯৭ সালে গিলাফ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
২০১৭ সালে বাদশাহ সালমানের নির্দেশনায় এর নাম দেওয়া হয় ‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা’স কিসওয়া’। পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ তৈরির প্রধান ক্যালিগ্রাফার হিসেবে দুই দশক ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশের শায়খ মুখতার আলম।
মূলত ৪৭ টুকরা কাপড় দিয়ে গিলাফ তৈরি করা হয়। ১৬ মিটার দৈর্ঘ্যের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেলাই মেশিনে করা হয় এসব কাজ। কারুকার্যের অনেক কাজ হাতেও করা হয়। কাপড়ের ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি অংশ একত্রে সেলাই করা হয় এবং তামার রিং দিয়ে গোড়ায় স্থির করা হয়। ৬৭০ কেজি কাঁচা রেশম কালো রং করা হয়।
২১ ক্যারেটের ১২০ কেজি স্বর্ণ ও ১০০ কেজি রুপার সুতা দিয়ে সেই কাপড়ে লেখা হয় পবিত্র কোরআনের কারুকাজখচিত আয়াত। গিলাফের সব কাজ শেষ করতে ছয় থেকে আট মাস সময় লাগে। সব মিলিয়ে ৮৫০ কেজি ওজনের এই গিলাফ তৈরিতে ব্যয় হয় ২৫ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা সাড়ে ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই গিলাফকে বিশ্বের ব্যয়বহুল কাপড় বলে মনে করা হয়।
(নিজস্ব প্রতিবেদক, ঘাটাইল ডট কম)/-
কপিরাইট © ২০১৮ - ২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত |
Design & Developed by RAN SOLUTIONS
আপনার মতামত লিখুন